Friday, 25 April 2025

পেহেলগাও জঙ্গি আক্রমণের দিন

 ২২ শে এপ্রিল, মঙ্গলবার ভোর পৌনে ৪ টায় আমরা পেহেলগাও হোটেল ছেড়ে জম্মুর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের ট্রেন রাত্রি ৯ টা ২৫ মিনিট। এত আগে রওনা দেবার কারণ ২০ শে এপ্রিল রবিবার মেঘভঙ্গা বৃষ্টিতে NH44  ধস নেমে গত দুই দিন রাস্তা বন্ধ। সোমবার সন্ধ্যা অবধি রাস্তা খোলেনি দেখে আমাদের কাশ্মীরি ড্রাইভার আজিজ ও ফাজিল সুলতান বললেন মঙ্গলবার রাস্তা ঠিক হবার কোনও আশা নেই। অথচ আমাদের জম্মু থেকে দিল্লি যাবার ট্রেন মঙ্গলবার। যদি এই ট্রেন ফেল করি তবে দিল্লি থেকে বেঙ্গালুরু ফিরবার প্লেন ধরতে পারব না। আবার আমার মা, বা, দিদির দিল্লি- শিয়ালদহ রাজধানী ট্রেনের টিকিটও ওই একই দিনে। অর্থাৎ যদি জম্মু ফিরে ট্রেন ধরতে না পারি তবে দিল্লির থেকে ট্রেন বা প্লেন কিছুই ধরতে পারব না। এতে আর্থিক ভাবে ক্ষতি তো হবেই তবে তার চেয়েও বড় সমস্যা হবে ঘরে ফিরবার ট্রেন বা প্লেন এর টিকিট পেতে। ইতিমধ্যেই শ্রীনগর থেকে দিল্লির প্লেন ভাড়া তখন বেড়ে ২০/২৫ হাজার টাকার বেশি। আমাদের দরকার মোট ৭টা টিকিট যা কেনা অসম্ভব। 


আমাদের ড্রাইবাররা নিজে থেকেই প্রস্তাব দিলেন ঘুর পথে জম্মু পৌঁছানোর জন্য। ঘুর পথ বলতে মোঘল রোড যা কিনা পীর পাঞ্জাল পাস্ থেকে অনেক ঘুরে জম্মু পৌঁছায়। রাস্তাটা পাকিস্তান বর্ডার ঘেষা। এই রাস্তা তৈরি করেছিলেন মোঘল সম্রাট আকবর, কাশ্মীর থেকে করাচি যাবার উদ্দেশ্যে, তাই এর নাম মোঘল রোড। NH44 দিয়ে শ্রীনগর -জম্মু যেখানে সময় নেই ৫/৬ ঘণ্টা, এই রাস্তা নেয় ১৫/১৬ ঘণ্টা বা আরও বেশি। রাস্তা খুবই দুর্গম, প্রায় ১২ হাজার ফিট উচ্চতায় বরফে ঘেরা রাস্তা আমাদের পার করতে হবে। এই রাস্তায় খুবই দুর্ঘটনা প্রবণ, খারাপ রাস্তা ও যেকোনো সময়ে ধস নামবার সম্ভবনা এই রাস্তায়। একদিকে দুর্গম রাস্তা  অন্য দিকে এই রাস্তায় প্রায় ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে নেই কোনও জন বসতি, নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক বা কোনও খাবারের দোকান। যদি গাড়ি খারাপ হয় তবে সেটা ঠিক করবার কোনও উপায় নেই এই ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে। এমন দুর্গম রাস্তা হবার ফলে কোনও ড্রাইভার এই রাস্তায় যেতে চায় না। এমনকি দ্বিগুণ ভাড়া দিলেও না। তারা পীর কি গলি নামক একটা জায়গা পর্যন্ত সর্বচ্চ যায় কারণ এখানে একটা দরগা রয়েছে। কিন্তু এর পরেই রাস্তা আরও খারাপ হয়। এই  রাস্তা পুরো শীতের সময় বন্ধ থাকে ও শীতের শেষে বরফ কেটে রাস্তা বের করা হয়। রাস্তার পাশে অনেক জায়গায় দেখেছিলাম ১২/১৫ ফুটের উঁচু জমা বরফ। যা কেটে রাস্তা বের করেছে সরকার। 


আজিজ ছিল আমাদের গাড়ির ড্রাইভার। বাড়িতে রয়েছে বয়স্ক বাবা-মা, স্ত্রী ও সন্তানরা। ওনার স্ত্রী একটা শাল এর কারখানায় শাল তৈরির কাজ করে তবে সংসারের মূল উপার্জনকারী মানুষ হলেই এই আজিজ। ব্যাংক লোন গাড়ি কিনে ভাড়ায় চালাচ্ছে। EMI এখনও চলছে। 


 আমাদের দুই ড্রাইভার এর আগে এক সপ্তাহ যাবত খুব ভাল ভাবে কাশ্মীর ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। আমাদের অসুবিধার কথা চিন্তা করে নিজেরাই সন্ধ্যা ৭:৩০ নাগাদ বললেন এই দুর্গম রাস্তা দিয়ে আমাদের নিয়ে আসবেন জম্মুতে। ভোর ৩ টায় আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে জম্মুর উদ্দেশ্যে। সেই অনুসারেই আমরা বেরিয়েছিলাম, তবে একটু দেরিতে প্রায় পৌনে ৪ টা নাগাদ। 

আমরা যখন পহেলগাম বাজার পার করছি তখন সময় প্রায় ভোর ৪ টা। রাস্তায় কোনও মানুষজন , আর্মি, নাইট গার্ড, পুলিশ এমন কি রাস্তার কুকুর বিড়াল পর্যন্ত ছিল না। বাইরে তখন শূন্য ডিগ্রির মতো তাপমাত্রা , গাড়ির হিটার চালিয়ে আমরা চলেছি। ভোর হলো সিফিয়ান নামক একটা ছোট শহরে। ড্রাইভার থেকে জানলাম এই জায়গার আপেল কাশ্মীরের মধ্যে সব চেয়ে সুস্বাদু। এখানেই রাস্তার প্রথম মানুষের দেখা পেলাম , এনারা দিনের প্রথম নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদে চলেছেন। তাদের থেকেই রাস্তা সম্পর্কে খোঁজ নিলেন আমাদের ড্রাইভাররা। রাস্তায় বেশ কয়েক জায়গায় আর্মি ক্যাম্প দেখলাম। কয়েক জায়গায় বাশ দিয়ে গেট বানানো কিন্তু একটু উঁচু করে রাখা যাতে ছোট গাড়ি বেরিয়ে যেতে পারে। সকাল ৬:১৫ নাগাদ সিফিয়ান শহরের বাইরে এক জায়গায় আমাদের আর্মিরা আটকে দিল। জানলাম সামনে শুরু হচ্ছে দুর্গম রাস্তা তাই দিনের আলো ভালোভাবে না ফোঁটা পর্যন্ত এই রাস্তায় কাউকে চলতে দেয় না। প্রায় দেড় ঘণ্টা দাড়িয়ে প্রায় ৮ টা নাগাদ আবার চলা শুরু হল আমাদের। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে রাস্তায় এক জায়গায় পুলিশে দাঁড় করিয়ে ড্রাইভারকে সতর্ক করে দিল এক বয়স্ক পুলিশ অফিসার। জানতে চাইল আগে এই রাস্তায় সে গিয়েছে কিনা। এর পর থেকে শুরু হলো সেই দুর্গম ৫০ কিলোমিটারের যাত্রা। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আজিজ ভাইকে দেখলাম এই পর্যন্ত না কিছু খেল না কোথাও চা বা সিগারেট এর জন্য দাঁড়াল। তার একটাই লক্ষ্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই দুর্গম ৫০ কিলোমিটার রাস্তা পার হয়ে যাওয়া। 


রাস্তায় শুধুমাত্র পীর কি গলি নামক জায়গায় দাঁড়ালেন। এখানে একটা দরগা আছে। আমাদেরও বললেন চাইলে ৫ মিনিট ঘুরে দেখতে। সময় তখন প্রায় সকাল ১০ টা। খুবই খিদে পেয়েছিল , অল্প কিছু খাবার কিনলাম এখানে দরগার পাশের দোকান থেকে।  উনি দরগায় প্রার্থনা করে অল্প কিছু অর্থ দান করলেন। এই জায়গাটি সম্ভবত ১১০০০ ফুট এর বেশি উঁচুতে। ছিলো ভীষণ ঠান্ডা তারপর তীব্র বেগে হাওয়া। ঠান্ডায় কাপতে কাপতে আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম। এই ঠান্ডায় দেখলাম এক বয়স্ক মানুষ লঙ্গর চালাচ্ছেন। তবে এই জায়গায় আসবার পথটি ছিল যেমন দুর্গম ঠিক তেমনি সুন্দর। পীর কি গলি পার হবার পরে দেখা পেলাম বরফ কেটে পরিস্কার করা রাস্তা। রাস্তার পাশে কোথাও ১০ ফুট তো কোথায় ১৫ ফুট উঁচু বরফ। সাথে ভাঙা পাহাড়ি একে বেঁকে চলা রাস্তা। শুধু এক দুই জায়গায় দেখা পেলাম পাহাড়ি ভেড়া পালকদের। তবে শ্রীনগর ও জম্মুর মধ্যে একমাত্র এই রাস্তা খোলা থাকার কারণে কিছু গাড়ি এই রাস্তায় চলছিল। আরও কয়েক ঘণ্টা চললাম এই রাস্তায়। তারপর সম্ভবত ১২/১২:৩০ নাগাদ দেখ পেলাম একটা ছোট পাহাড়ি গ্রামের। একটু এগিয়ে পেলাম কয়েকটা ছোট দোকান। এই প্রথমবার ড্রাইভার কে একটু চাপ মুক্ত দেখলাম। এখানেই প্রথম চা ও সিগারেট খেতে খেতে বলল আর চাপ নেই। আমরা সময় মতো পৌঁছে যাব জম্মুতে। আবার শুরু হলো আমাদের পথ চলা। এখনও ৫/৬ ঘণ্টার পথ বাকি আমাদের। রাস্তায় ছিল না দুপুরে খাবারের মতো কোনও দোকান। এই রাস্তাতেই দুপুর ৩ টা নাগাদ প্রথম খবর পেলাম পেহেলগাঁওতে জঙ্গি আক্রমণ হয়েছে। প্রথম খবর ছিলো দুই জন মতো আহত। 


দুপুর সাড়ে ৩ টা নাগাদ জম্মুর কাছাকাছি একটা জায়গায় খুব ছোট একটা হোটেলে  দাঁড়াই দুপুরের খাবারের উদ্দেশ্যে। তবে খাবার বলতে শুধু মাত্র রাজমা- ভাত আর তার সাথে পাঁপড়ের মতো চাপাটি রুটি। খাবারের পর পথে আর কোথাও না দাড়িয়ে আমরা চললাম জম্মুর উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যা প্রায় ৭ টা নাগাদ পৌঁছলাম জম্মু তাওয়াই স্টেশনে। শেষ হলো আমাদের প্রায় ১৫ ঘণ্টার যাত্রা। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার আজিজ ভাই গাড়ি থেকে নেমে জল খেতে গিয়ে মাথা ঘুরে বসে পড়লেন মাটিতে। এত লম্বা জার্নি, প্রায় কোনও রকম বিশ্রাম ছাড়া তারপর আগের রাত্রে মাত্র ৩/৩:৩০ ঘণ্টা ঘুম, সব মিলে শরীর ধকল নিতে পারেনি। তবু আমাদের কথা ভেবে এনারা এতটা কষ্ট করলেন। যদি ওই দিন এনারা আমাদের এভাবে কাশ্মীর থেকে বের করে না আনতেন তবে আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ হত। আমাদের দুই ড্রাইভার এর ছবি ও রাস্তার কয়েকটি ছবি দিলাম এই পোস্টে। 



—————————————- 

কাশ্মীরের পহেলগাও তে জঙ্গিরা যেভাবে সাধারণ পর্যটকদের ওপর বর্বরদের মতো গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে - এই ঘটনার নিন্দা করে কোনও লাভ আছে বলে মনে করি না, কারন এসব জঙ্গিদের কাছে এসব নিন্দার কোনও অর্থ নেই। আশাকরি আমাদের সরকার সেসব জঙ্গিদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দেবে। যে সকল মানুষ তাদের প্রিয়জনকে হারালো তাদের প্রতি সমবেদনা জানানো ছাড়া আমাদের আর কিই বা করবার আছে? দাবি করব সরকার যেন সেসব পরিবারকে যথাযথ আর্থিক সাহায্য করে যাতে মৃত দের  পরিবারের আর্থিক ভাবে সুবিধা হয়। সরকার ইতিমধ্যেই স্বীকার করেছে তাদের কিছু ভুল ছিলো- এটা কাশ্মীর ঘুরবার সময় আমারও মনে হয়েছে কারণ বেশিরভাগ টুরিস্ট স্পটে সেভাবে সুরক্ষা ব্যবস্থা দেখিনি। হয়ত সরকার ভেবেছিল সাধারণ টুরিস্ট জঙ্গিদের টার্গেট হবে না। কিন্তু এসব বর্বরদের কাছ থেকে এমন নীতি নৈতিকতা আশাকরাই বড় ভুল। আশাকরি আগামীতে সরকার সে ভুল শুধরে নেবে। জঙ্গি আক্রমণের পরে গোটা দেশে বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ কাশ্মীরি আক্রান্ত হচ্ছে, এটা কখনোই কাম্য নয়। আমাদের সাহায্য করলেন তারাও যেমন সাধারণ কাশ্মীরি আবার জঙ্গি আক্রমণের প্রতিরোধ যে টুকু হয়েছিল সেও ছিলো সাধারণ কাশ্মীরি। টুরিস্টদের বাঁচাতে গিয়ে সে নিজেও প্রাণ হারিয়েছে। আবার ভিডিওতে দেখেছি কিভাবে সাধারণ কাশ্মীরি আহতকে পিঠে করে দৌড়ে নিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য। খবরে পড়লাম কিভাবে স্থানীয় কাশ্মীরি টুরিস্ট ছোট মেয়েকে নিজের শরীর দিয়ে আগলে রেখেছে যাতে তার গুলি না লাগে - এভাবে সাধারণ কাশ্মীরি মানুষরাই টুরিস্টদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলন, কেউ থাকবার জায়গা দিয়েছেন, কেউ খাবার দিয়েছেন আবার কেউ ফ্রি তে নিরাপদ জায়গায় টুরিস্টের পৌঁছে দিয়েছে। এসব ভিডিওতে দেখেছি বা খবরে পড়েছি। জঙ্গি আক্রমণের প্রতিবাদে কাশ্মীরে ইতিমধ্যেই মোমবাতি নিয়ে প্রতিবাদ ও গোটা কাশ্মীরে দুই দিন সার্বিক ভাবে বনধ হয়েছে। তাই অনুরোধ করব সাধারণ কাশ্মীরি মানুষের যেন কেউ জঙ্গিদের সাথে গুলিয়ে না ফেলে। তারাও আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যারা শুধুমাত্র শান্তিতে বাঁচতে চায়। 

পেহেলগাও জঙ্গি আক্রমণের দিন

  ২২ শে এপ্রিল, মঙ্গলবার ভোর পৌনে ৪ টায় আমরা পেহেলগাও হোটেল ছেড়ে জম্মুর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের ট্রেন রাত্রি ৯ টা ২৫ মিনিট। এত আগে রও...