১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গা মা ভারত আসবার সময়ে দীর্ঘ জলপথ অতিক্রম করে ভারতবর্ষের উপকূলের এই দ্বীপটি দেখতে পায়। যীশু খ্রিস্টের মা মেরির নাম অনুসারে তিনি এর নাম দেন সেন্ট মেরি আইল্যান্ড। এই দ্বীপে প্রচুর নারকেল গাছ থাকার ফলে এর আরেকনাম নারকেল দ্বীপ।
ঘুরবার জন্য এই দ্বীপ খুবই সুন্দর। মালপে বিচ থেকে প্রতি ২০ মিনিটে মোটর বোট ছাড়ে এখানে যাবার জন্য। আসা যাওয়ার জন্য মাথা পিছু টিকিট ৪০০ টাকা। প্রায় ২৫-৩০ মিনিট লাগে এইখানে পৌঁছাতে। তারপর এক ঘন্টা ঘুরে আবার ফিরে আসা যায় এই মোটর বোট করে। সকাল থেকে শুরু করে বিকাল সাড়ে ৩ টায় শেষ বোট এই দ্বীপে যাবার জন্য মালপে থেকে ছেড়ে যায়।
আমরা টিকিট কেটে উঠে পড়লাম এমন একটা বোটে বা ইঞ্জিন নৌকায়। বেশ কিছুটা জলে নেবে এই নৌকায় উঠতে হল। তারপর শুরু হল এই দুর্দান্ত যাত্রা। আরব সাগরের সবুজ জলরাশি চিরে এই বোট চলল দূরে অস্পষ্ট এক জায়গার উদ্দেশে। এই নৌকা গুলি যখন জল চিরে চলছিল, জল যেন লাফিয়ে উঠে ছুটে আসছিলো আমাদের ওপরে। ক্রমেই হালকা একটা বিন্দুর মতো জায়গা পরিষ্কার চেহারা নিলো। সময়ের সাথে সাথে স্পষ্ট হল এই দ্বীপ। দূর থেকে দেখতে পেলাম নারকেল গাছ গুলিকে। কিছুক্ষন বাদেই দ্বীপের উপকূলে নামলাম আমরা, আবার জল ভেঙে ডাঙায় উঠতে হলো। দ্বীপ থেকে ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডই যেন দিগন্তে মিলিয়ে গিয়েছে, দেখা যাচ্ছে হালকা একটা সাদা দাগ।
দ্বীপটির ভেতরে কয়েক পা এগোলেই দেখা পেলাম পাথরের সব থাম বা পিলার। নোটিস বোর্ড জানাল এই দ্বীপটি ভারতের ন্যাশনাল জিওলজিকাল মনুমেন্ট তকমা পেয়েছে এর ভূপ্রকৃতির জন্য। এই ভূপ্রকৃত ভারত বর্ষে আর কোথাও নেই। জানলাম এমন পাথরের থাম রয়েছে পৃথিবীর সামান্য কিছু জায়গায় যেমন কাছাকাছির মধ্যে উত্তর পশ্চিম ইউরোপের আয়ারল্যান্ড এ।
দ্বীপটি তৈরী হয়েছে আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে আজ থেকে ৬০ মিলিয়ন বছর বা ৬ কোটি বছর আগে। লাভার থেকে এই দ্বীপে তৈরি হয়েছে অসংখ্য থাম বা পিলার। আর সব পিলারগুলো যেন পুরো দ্বীপটিকে মোজাইক এর মতো সাজিয়েছে। আরো আশ্চর্যের এই পিলারগুলো সাধারণত ষড়ভুজ বা বহুভুজ আকৃতির, যা প্রকৃতিতে বিরল। দ্বীপটি ভারতবর্ষের সাথে সমান্তরালে অবস্থিত। বিজ্ঞানীরা দ্বীপের এই পাথরগুলি থেকে আবিষ্কার করেছেন যে ভারতবর্ষ এক সময় আফ্রিকার মাদাগাস্কার দেশের সাথে যুক্ত ছিল।
পায়ে পায়ে আমরা এগিয়ে চললাম দ্বীপের ভেতরের দিকে। চার দিকে জঙ্গল আর তারপরই অসংখ্য নারকেল গাছ। এই দ্বীপে কোনোদিন মানুষের বসতি তৈরি হয়নি। নেই কোনো বড় প্রাণী। কিছু পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে এই দ্বীপের আকাশে। কতৃপক্ষ মাঝে মাঝে মানুষের বসে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে রেখেছে। আমরা হাটতে হাটতে অল্প সময়ের মধ্যেই চলে এলাম দ্বীপের অপর দিকে। এই দিক পুরোটাই পাথরে ঢাকা, নেই সামান্যতম সমুদ্রতঠ। তবে আশ্চর্যের এখানে পেলাম শামুক ও ছোট ঝিনুকের অসংখ্য শেল বা খোল। এই ছোট খোল গুলিই যেন সমুদ্র তঠ তৈরি করেছে।
সূর্যের তাপ এতক্ষনে একটু কমেছে, সমুদ্রের ঠান্ডা বাতাস বেশ আরামের। আমরা বেশ কিছুক্ষন কাটিয়ে , অনেক ছবি তুলে বিশ্রাম নিলাম এই দ্বীপে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পাথরের কোনো একটির পরে বসে। পাশে কাজু গাছের মতো একটা গাছ দেখে কাছে গিয়ে দেখলাম অন্য কোনো গাছ, যা আগে কখনো দেখিনি। হয়তো এই দ্বীপের নিজস্ব কোনো উদ্ভিত , হয়তো সুদূর মাদাগাস্কার দেশের সাথে মিল আছে এর।
একটু দূরে রয়েছে আরো বেশ কিছু উঁচু পাথর। সরকারি নির্দেশ সেসবের পরে যেন কেউ না ওঠে। তবে বেশ কিছু অতুৎসায়ী ভ্রমণ পিপাসু তার ওপরে উঠেই দ্বীপের মজা নিতে ব্যস্ত। তবে এই দ্বীপের শুরুতেই নোটিস বোর্ডের মাধ্যমে সরকার সকলকে সাবধান করে দিয়েছে এই দ্বীপের বিপদ সম্পর্কে যা লুকিয়ে রয়েছে এই লাভার তৈরী পিলারের মতো পাথরগুলির মধ্যে। এর ধার গুলি যেন ব্লেডের মতো আর কোথাও ১০ ফিট উঁচু তো কোথাও নিচু। এসব পাথরের ওপরে উঠে একটু ভুল হলেই হতে পারে বড়ো কোনো বিপদ।
এসব দেখতে দেখতে আমাদের এক ঘন্টা প্রায় শেষ হয়েছে, ফলে ফিরবার পথ ধরলাম। পথে দেখলাম নারকেল কাছের ওপরে সমুদ্র চিলের বাসা। দ্বীপের গেটের কাছে আসতেই ডাক পেলাম তাড়াতাড়ি বোটে চড়ে বসবার। ফিরবার সময় নৌকার মাঝি টিকিট দেখতে চাইল। ভ্যাগিস সেটা গুছিয়ে রেখেছিলাম নইলে হয়তো নৌকায় উঠতেই দিতো না।
গোটা দ্বীপে ছিল না কোনো বাথরুমের ব্যবস্থা বা জল পান বা কোনো খাবারের ব্যবস্থা। ফলে এখানে যাবার আগে এসব জিনিসগুলি নিজেকেই ব্যবস্থা করে যেতে হবে।
তখন সময় প্রায় বিকাল ৫ টা। হয়তো এটাই ফিরবার শেষ নৌকা। এবার নৌকায় বেশ ভিড়। কোথাও বসবার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়েই থাকতে হলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই মোটরের নৌকা বীর বিক্রমে জল চিরে আবার চলল ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের উদ্দেশ্যে। সুন্দর এই দ্বীপটি ধীরে ধীরে আবার ছোট হতে হতে এক সময়ে মিলিয়ে গেল দিগন্তে। দূর থেকে বড় নারকেল গাছে সারি এক একটা বিন্দুতে পরিণত হল। তারপর সেটাও আর দেখা গেল না। একটু পরেই নৌকা পৌছালো মালপে সমুদ্র সৈকতে। এর সাথে সাথে আমাদের এই সন্দুর সেন্ট মেরি আইল্যান্ড বা নারকেল দ্বীপ ভ্রমণ সম্পূর্ণ হল।