Thursday, 30 November 2023

বাংলার বাইরে আরেক বাংলা


নদীডোবাবিলমাছধানক্ষেতে - বাংলা বললে এমনই এক দৃশ্য আমাদের মনে ভেসে ওঠে।  এমন জায়গা যেখানে গ্রামের পাস দিয়ে বয়ে যাবে নদী বা অন্তত একটা খাল। সেই খালের জলে থাকবে মাছ।  আর  জল শুকিয়ে গেলে  দিগন্ত  বৃস্তিত মাঠে ধান ক্ষেতের ওপরে দিয়ে বয়ে যাবে কোমল হাওয়াসেই হাওয়ায় সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ঢেউ উঠবে ধানের খেতে। গ্রামের প্রতিটা বাড়িতে থাকবে ধানের  গোলা আর বৃষ্টির সময় যাতায়াতের জন্য থাকবে নৌকা।  মানুষের খাবারের পাতে থাকবে অন্তত একটা মাছ আর ভাত।  বাংলার এই রূপ চির পরিচিত।  অবশ্য এই সকল জিনিস যে শুধু বাংলায় নয় , তার বাইরেও আছে সেটা বুঝেছিলাম ভারতবর্ষের একেবারে দক্ষিণে আরব সাগরের পাড়ে থাকা একটা জায়গায়। আজ বলব সেই ঘুরবার গল্পযা আমাকে ভীষণ ভাবে অবাক করেছিল।  তারই সাথে এও বলব যে এমন এক জলা জায়গা কিভাবে ভারত সহ গোটা পৃথিবীর কাছে অন্যতম জন্যপ্রিয় ভ্রমন গন্তব্য উঠল  মানুষের আয়ের একটা প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ালো।  এই গল্প বাংলার বাইরে আরেক বাংলার গল্প।   


ভারতবর্ষের দক্ষিণে অবস্থিত কেরল রাজ্যের আলেপ্পিকেরলের প্রধান দুটি  জন্যপ্রিয় জায়গা এর একটি। কেরল রাজ্য যা আছ্ ভারতের একেবারে দক্ষিণের ভারত মহাসাগরের থেকে শুরু করে আরব সাগর ঘেসে উত্তরে প্রায় সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটার জুড়ে থাকা এক ছোট রাজ্য। এই রাজ্য লম্বায় সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটার হলেও চাওড়াতে মোটেই বলবার মতো কিছু নয় , সব থেকে মোটা জায়গাটাও  মাত্র ১২৫ কিলোমিটার মতো।  অথচ এই অল্প জায়গার মধ্যেই আছে আশ্চর্য ভূপ্রকৃতিপূর্বে সুউচ্চ পাহাড় , আর পশ্চিমে আরব সাগর।  এরই মাঝে এক চিলতে সমতল জায়গা। এই ছোট জায়গার ভূপ্রকৃতি এতটাই সুন্দর যে এখানে মানুষরা এই রাজ্যকে বলে ঈশ্বরের নিজের দেশ।  মৌসুমী বায়ু যখন ভারতে আসেপ্রথমেই এই পাহাড়ে ধাক্কা খায় আর এখানে হয় প্রচুর বৃষ্টি।  এই জল ধারা ধীরে ধীরে পাহাড় থেকে নেমে চলে আসে সমতলেতৈরি করে অসংখ্য নদী - খাল - বিল।  কিন্তু এই জল প্রাকৃতিক কারণে পুরোটা সমুদ্রে চলে যেতে পারেনাসমতলে আটকে থেকে তৈরি করে জলা জায়গাযাকে বলে ব্যাক ওয়াটার।   সমতলের নিচু জায়গা গুলি প্রতি বছর এই জলে ডুবে যায়।  তৈরি হয় মানুষের জল যন্ত্রনা। অবশ্য জল যন্ত্রণাকে আর বর্তমান বলা যায়নাএমনটা আগে হতো কিন্তু বর্তমানে এই জলই এদের ভাগ্য খুলে দিয়েছে।    আলেপ্পি এমনই একটা যায়গা যেখানে প্রায় ১৫-২০ টা গ্রাম নিয়মিত বৃষ্টির সময়  চলে যায় জলের নিচে। বাকি সকল জায়গার সাথে থাকেনা স্থল পথে কোনো যোগযোগ ব্যবস্থা , নৌকাই একমাত্র যাতায়াতের ব্যবস্থা। আমাদের যেমন সাইকেল - মোটর সাইকেল বা গাড়ি থাকে , ওদের থাকে হাতে টানা ছোট নৌকা বা ডিঙি - মোটর দেয়া নৌকা - শিকারা,  বিশাল বড়ো নৌকা বা হাউস বোট।  এই হাউস বোটের মধ্যে থাকে বেশ কয়েকটি ঘর , রান্নার জায়গা , বাথরুম , এসি , জেনারেটার আরো কতকি!  আবার এখানে চলে জল -বাস , আমাদের যেমন রাস্তায় বাস চলে , এখানে চলে বড় মোটর নৌকা , যাকে বলে জল-বাস।  


---------------


আমরা এই জায়গায় পৌঁছেছিলাম গাড়িতে করে।  অবশ্য চাইলে ভারতের যেকোনো জায়গা থেকে ট্রেনে এই আলিপ্পি চলে আসা যায়।  তারপর অটো বা টুকটুক ধরে চলে যায় হাউস বোট ভাড়া নেবার জায়গায়। এখানে যদি অন্তত এক রাত্রি থাকার প্ল্যান থাকে তবেই অবশ্য হাউস বোট নইলে ছোট নৌকা যাকে এখানে শিকারা বলেসেই জন্য কয়েক ঘন্টার জন্য ভাড়া নিয়ে ঘুরে নেয়া যায় এই গ্রাম গুলো। যদি হাউস বোট হয় তবে আপনার এখানেই থাকা  খাবারের ব্যবস্থা করবে। পুরোদিন নদীর অলি - গলি ঘুরিয়ে রাতে কোথায় দাঁড়িয়ে যাবে আবার সকালে ঘুরিয়ে আপনায় ছেড়ে দেবে যেখানে থেকে আপনার যাত্রা শুরু হয়েছিল। অবশ্য তারজন্য বেশ কিছু পয়সা গুনতে হবে। এই যেমন সিজিন হিসাবে দিনে   থেকে ১৫ হাজার ভারতীয় টাকাথাকা  খাবার এর মধ্যেই   ফলে যদি একটু সস্তায় ব্যাপারটা উপগভোগ করবার ইচ্ছা থাকে তবে শিকারা আছেই।  - ঘন্টার জন্য ভাড়া নিয়ে গ্রাম গুলির আলী-গলি ঘুরে নিন।  এতে অবশ্য মাত্র ১২০০-২৫০০ টাকার মধ্যেই হয়ে যাবে। অবশ্যই শুধু ঘোরা। 


আমাদের পকেটে টান কম তাই শিকারার জয় বলে উঠে পড়লাম একটায়। তিন ঘন্টা ঘুরে দেখাবে।  আমাদের মাঝি মাইকেল। স্থানীয় এক গ্রামের লোক।  এই নৌকা চালিয়েই তার দিব্যি সংসার চলে। সিজিনে  দিনে গড়ে দুই - তিন  বার কাস্টমার পেয়ে যায়। মানে দিনের শেষে - হাজার আয়।  অবশ্য এই নৌকা গুলি হাতে টানা নয়।  মোটরে চলে ফলে তেলের খরচ আছে।  আর নৌকা নিজের না হলে তার ভাড়াও গুনতে হয়।  যাইহোক দিনের শেষে তবু কম করেও কয়েক হাজার আয় হয়ে যায়।  এই জন্যই বলেছিলাম এদের এই জল আজ সৌভাগ্যের।  মাইকেল দিব্যি একটা সরু খালের মধ্যে দিয়ে নিয়ে চলল আমাদের নৌকা।  মৃদু বাতাস আর খালের চারিদিকে নারকেল ঘেরা  গ্রামের দৃশ্য সত্যিই মনো মুগ্ধকর।  কিছুটা গিয়ে পড়লাম একটা বড় বিলে।   ব্যাপারটা যেমন গলি থেকে এসে কোনো একটা বড় মাঠের মধ্যে এসে পড়েছি।  সেখানে আবার সরকার  সুন্দর একটা বসবার জায়গায় করে দিয়েছে। সেখানে ডাবচা  অন্য সব খাবারের দোকান। বেশ মজার , চারিদিকে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ডাব বা চা যা ইচ্ছা খাও।  ওদেরও সকলে  মিলে মিশে বেশ ভাল আয়ের ব্যবস্থা। 


কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে আবার চলল আমাদের নৌকা।  এবার খালের ভেতর দিয়ে যেতে মাইকেল গল্প বলছিলতাদের গ্রামের গল্প। আগে এক সময় এই গ্রামগুলিতে বন্যার জলে ডুবে যেত আর মানুষের থাকবার বা খাবারের ব্যবস্থা থাকতো না। জিজ্ঞাসা করলাম , আগে ডুবে যেত মানে কি এখন ডুবে যায় না ? হেসে দেখাল অদ্ভুত একটা জিনিস। আমরা খালের যে জলের ওপর দিয়ে যাচ্ছি সেটা পাশের গ্রামের মানুষের বাড়ির প্রায় ছাদের সমান উঁচুতে।  খালের রয়েছে উঁচু বাধ। এই বাঁধ বা পাঁচিল গ্রামগুলিকে জল থেকে রক্ষা করছে।  আর গ্রামের খালি জায়গায় হয়েছে সুন্দর ধানের খেতযার ওপর দিয়ে  হাওয়া খেলে যাচ্ছে তৈরী করছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো সব ঢেউ।   


এই খাল গিয়ে মিশেল আরেকটা বড়ো খালে। এখানে দেখলাম জল-বাস  হাউস বোট গুলি ভেসে চলেছে।  ব্যাপারটা যেন একটা গলি এসে একটা পাকা রাস্তায় মিলছে আর সেখানে চলছে বড়ো বাস - গাড়িআগের গ্রামটা শেষ করে আবার একটা বড়ো বিল।  তারপর আরেকটা খালে ঢুকে এগিয়ে যেতেই মাইকেই দেখালো তার বাড়িটি। ছোট কিন্তু বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো।  উঠানে বেশ কিছু ফলের গাছ।  যদিও মাটি এই  খালের জলের থেকে এক মানুষ নিচুতে।  পাশেই আরেকটা গ্রাম। গ্রামগুলি আলাদা হয়েছে এই সকল খালের মাধ্যমে।  নেই কোনো ব্রিজ নেই সাঁকো।  আছে প্রতিটা বাড়ির সামনে হাতে টানা নৌকা আর মোটর দেয়া অন্তত একটা নৌকা।  এই নৌকাই এদের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম।  গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম এখানে সব বাড়িই পাকা , নেই কোনো কাঁচা বাড়ি। অনেক বাড়ি আবার দুই তোলা।  সেসব বাড়ির মাঝে মাঝে আছে ছোট সবজি বা মুদির দোকান।  অবশ্য মাছ এর দোকান দেখলাম না।  দরকারও নেই , মাছ তো খালে আছেই যত ইচ্ছা ধরে নাও।  এসব ভাবতে ভাবতে এসে পড়লাম বিশাল বড়ো আরেকটা নদীতে।  এটা যেন হাই ওয়ে বা রাজপথ।  আবারো আরেকটা গ্রাম।  এতক্ষনে খেয়াল করলাম আগের প্রতিটা গ্রামে চার্চ বা মজ্জিদ থাকেও মন্দির দেখিনি।  এই গ্রামে আছে মন্দির।  আসলে এই কেরলে হিন্দু - মুসলিম-খ্রিস্টান সকল মানুষের বাস।  নেই কোনো মারামারি নেই দাঙ্গা।  এবার নৌকা ভিড়ল একটা হোটেলে।  আবারো নদীর পশে একজনের বাড়িতেই হোটেল।  আছে সদ্য ধরে আনা বিভিন্ন ধরণের মাছ।  ব্যবস্থা বেশ সুন্দর , কাঁচা মাছ ওজনে কেনো আর একটু বসলেই ফ্রেশ মাছ পরিষ্কার করে দারুন ভাবে ভেজে দেবে খাবার জন্য। আমরাও ৯০০ টাকায় এক কিলো স্থানীয় এক ধরণের মাছ কিনলাম। এটা দেখতে কিছুটা তেলাপিয়া  পমফ্রেট এর মতো।  গরম গরম এই মাছ ভাজাএকেবারে অতুলনীয়। খিদে কারো পাইনি তাই আর ভাত খেলাম না।  কিছুক্ষন এখানে কাটিয়ে আবার উঠে বসলাম মাইকেলের শিকারায়।  প্রায় তিন ঘন্টা হয়ে গিয়েছে , এবার আমরা ফিরব। এই ফিরবার পথে চেয়ে রইলাম ওই সকল খালে - বিলে ঘেরা নারকেল গাছের আড়ালে থাকা গ্রামের দিকে। ভাবলাম পাহাড়ের বৃষ্টির যে জল এই সময় এই সকল মানুষকে প্রতি বছর বন্যায় ফেলে সর্বশান্ত করে ছাড়তোসেই সকল জলকেই নিয়ন্ত্রণে এনে কি সুন্দর চাষের কাজ , মাছের ব্যবস্থা আর ভ্রমণের উপযুক্ত এক ব্যবস্থা করেছে যা কিনা গোটা ভারত তথা গোটা পৃথিবীর কাছে অন্যতম এক আশ্চর্যের  জনপ্রিয় গন্তব্যএই জল এখানের মানুষকে আজ সব দিকথেকে সম্মৃদ্ধ করছে।  ১০০শিক্ষিত এই জায়গায়  নেই কোনো দারিদ্রতা , নেই কোনো ধমীয় বিবাদসদাহাস্য এই সকল মানুষ আজ নিজেদের চেষ্টায় এই প্রতিকূল জায়গাকে বানিয়ে তুলেছে অন্যতম সেরা।  আজ এটা সত্যিই   Gods own country  - ঈশ্বরের নিজের দেশ।

পন্ডিচেরী ভ্রমণ গাইড

পন্ডিচেরী দক্ষিণ ভারতের অন্যতম ভ্রমণ স্থান। পন্ডিচেরী জায়গাটি তামিলনাড়ুর পাশে বলা ভাল তামিলনাড়ু ঘেরা ছোট্ট একটি কেন্দ্রশাসিত জায়গা।  পন্ডিচে...